দলিল নিবন্ধনে অনিয়ম দুর্নীতি - কী হচ্ছে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে
মুকসুদপুর সাব-রেজিস্ট্রার এর অফিসে দলিল সম্পাদন নিয়ে বেশ কয়েকটি অনিয়ম দুর্নীতির ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে। এর কয়েকটি ঘটনা নিয়ে মুকসুদপুর সংবাদের ১ এপ্রিল, ১৬ মার্চ ও ১ মার্চ সংখ্যায় বিভিন্ন শিরোনামে সংবাদ-প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে, পাঠক নিশ্চয় পত্রিকা পাঠে অবহিত হয়েছেন তবু এর সংক্ষিপ্ত বিবরণ উল্লেখ করছি।
১এপ্রিল ২০২৪ সংখ্যা: ভুয়া আইডিতে দলিল রেজিস্ট্রি আদালতে ভুক্তভোগীর মামলা’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদ বিবরণÑপ্রভাকরদী গ্রামের প্রয়াত ধীরেন্দ্র নাথ কর্মকার এর ৪ পুত্র দীলিপ কর্মকার,পল্টু কর্মকার,সান্ত কর্মকার ও রাধেশ্যাম কর্মকার। একমাত্র রাধেশ্যাম কর্মকার দেশে অবস্থান করেন, বাকী ৩ভাই পাশের দেশ ভারতে অবস্থান করেন। এর মধ্যে সান্ত কর্মকার ভারতে মৃত্যুবরণ করেছেন। বিগত ২০১৬ সালে তারা ৩ ভাই ৩টি দলিলে একই গ্রামের পলাশ কর্মকার ও প্রহলাদ কর্মকারের নিকট কিছু জমি বিক্রয়-হস্তান্তর করেছেন। সম্পাদিত দলিলে দাতাদের পরিচিতির স্বপক্ষে ভুয়া জাতীয় পরিচয় পত্র ব্যবহার করা হয়েছে। এতে সংক্ষুব্দ হয়ে অপর ভাই রাধেশ্যাম কর্মকার আদালতে মামলা দায়ের করেছেন।
১৬ মার্চ সংখ্যা:
স্পট: সাব-রেজিস্ট্রি অফিস: নেপথ্য কারিগর ফারুকের কারসাজিতে জাল-ভুয়া দলিল ॥ কর ফাঁকির কৌশলে দাতা-গ্রহীতার পকেট কেটে সর্বনাশ শিরোনামে তিনটি ঘটনার অনিয়ম দুর্নীতির বিবরণ আছে উপ শিরোনামে।
১. আবুল হোসেন- কুদ্দুস এর হেবা- দানপত্র দলিল। প্রকাশ পৌরসভার প্রভাকরদী গ্রামের আবদুল কুদ্দুস পূর্বের ক্রয় করা জমির দলিল করেন। দলিলটি প্রথমে সম্পাদিত হয় হেবার শর্তে আপন সহোদর দেখিয়ে, কার্যত তারা চাচা ভাতিজা। বিষয়টি প্রকাশ পায় দলিলের সইমহুরি কপি হাতে পেলে। দাতা-গ্রহীতার দাবি কারসাজিটি করেছেন দলিল লেখক, সরকারী কর-ফি কম দিয়ে বাড়তি অর্থ আত্মসাতের জন্য। উপরন্তু তাদেরকে একটি দানপত্র দলিলের তুলনামূলক (কম্পেয়ার) কপি হাতে ধরিয়ে দিয়েছে। বিষয়টি জানাজানি হলে দলিল দাতা জমিটি পুনরায় দলিল করে দেন নিজের ছেলেকে। ফলে গ্রহীতা জমি পেতে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন।
২. মৃত আমেনা খাতুনের নামে জাল দলিল: চন্ডিবরদী গ্রামের মৃত আমেনা খাতুনকে জীবিত দেখিয়ে আমেনা খাতুনের ভাতিজা আবদুল কুদ্দুস ফুফুর পৈত্রিক সম্পত্তির অংশ জাল দলিল করে নিয়েছেন। জমিটি রেল প্রকল্পে অধিগ্রহণ হওয়ায় জাল দলিলের মাধ্যমে স্বত্ত দাবি করে সরকারী অর্থ উত্তোলন করেছেন। বিষয়টি প্রকাশ পেলে শেষ পর্যন্ত আমেনা খাতুনের উত্তরাধিকারদেরকে জমির মূল্য বাবদ কিছু অর্থ ফেরৎ দিয়ে বাকীটা আতœস্থ করেছেন। এটিও সম্ভব হয়েছে দলিল লেখকের কারসাজির মাধ্যমে।
৩. হোসেন আক্তার সাহেদ- শুকুরন নেছা বেগমের নামে ভুয়া দলিল। দাতা গ্রহীতা উভয়ে পরস্পর আত্মীয়। জমি ক্রয়-বিক্রয় করতে দলিল লেখকের কাছে গিয়েছেন, তাদের থেকে কাগজপত্র টাকা পয়সা রেখে পরবর্তীতে গ্রহীতাকে একটি দলিল ধরিয়ে দিয়েছেন। পরে জানা গেছে দলিলটি ভুয়া, আদৌ দলিলটি রেজিস্ট্রেশনই হয়নি। এটিও দলিল লেখকের কারসাজি, কার্যত তিনি দলিল লেখক নন, দালাল মাত্র।
এর আগের ১ মার্চ ২০২৪ সংখ্যায় কর ফাকির ৬ লাখ প্রতারক চক্রের ॥ জমির মূল্যে হেরফের ৯৪ লাখ টাকার জমি দলিলে ৪ লাখ। এতে প্রকাশ পেয়েছে প্রভাকরদী গ্রামের সৈয়দ কামরুজ্জামানকে পাওয়ার অব এ্যাটর্নি দিয়ে ৯৪ শতক জমি হস্তান্তর করেছেন চন্ডিবরদী গ্রামের লিয়াকত আলী সরদার। সেই জমি সৈয়দ কামরুজ্জামান তার ভাই সৈয়দ শমশের আলী ও আত্মীয় নান্নু শেখের নিকট বিক্রয় করেছেন। সাফ-কবলা দলিলটি সম্পাদিত হয়েছে জমির মূল্য ৪ লাখ টাকা মূল্য দেখিয়ে কিন্তু তাদেরকে ধরিয়ে দেয়া হয়েছে একটি ভুয়া তুলনামূলক (কম্পেয়ার) কপি। যেখানে জমির মূল্য দেখানো হয়েছে ৯৪ লাখ। কার্যত সরকারী কর ফাঁকি দিতেই জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে মূল্য কম দেখানোর মাধ্যমে বাড়তি অর্থ আত্মস্বাৎ করা হয়েছে।
পাঠক আমরা মনে করি জমি ক্রয়-বিক্রয়ে রেজিস্ট্রেশন নিয়ে দাতা-গ্রহীতা, দলিল লেখক এবং রেজিস্ট্রি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ সংশ্লিষ্ট থাকেন। এর বাইরেও একটি দালাল চক্রের উপস্থিতির প্রমাণ মিলেছে, যাদের বৈধ কর্তৃত্ব নেই কিন্তু সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। বর্ণিত অনিয়ম, দুর্নীতি অপরাধের দায় অনেকের থাকলেও স্বীকারে অনাগ্রহী থেকে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাতে চেষ্টা করবেন। ফলে এসব ঘটনার দায় নিরূপণ ও অপরাধের বিচার করে শৃঙ্খলা ফেরাতে ঘটনার আনুপূর্বিক তদন্ত হওয়া আবশ্যক। আমরা মনে করি দলিল লেখকের মাধ্যমে লিখিত দলিলপত্রাদি উপযুক্ত দালিলিক প্রমাণাদিসহ রেজিস্ট্রেশনের জন্য দাখিল হওয়ার পরে উপযুক্তভাবে যাচাই-বাছাই হলে অধিকাংশ অনিয়ম দুর্নীতি ধরা পড়ার কথা। সেক্ষেত্রে জমির শ্রেণি পরিবর্তন, মূল্য কম দেখানো (আন্ডার ভ্যালু), বা মৃতকে জীবিত দেখিয়ে সম্পাদন হওয়া অসম্ভব। ফলে অনেকেই এর সংগে জড়িত থাকার অনুমান করা অসমীচীন নয়। তদুপরি দলিল লেখক বা দালালদের নিয়ন্ত্রণ করাও অসম্ভব কিছু নয়। কার্যত তারাও রেজিস্ট্রেশন কাজের অংশীদার। অনৈতিক কাজ করলে তারাও জবাবদিহি কিংবা শাস্তির মুখোমুখি হতে পারেন। আমরা চাই জমি রেজিস্ট্রেশনের জন্য জনগণের ভোগান্তি নিরসন ও অনিয়ম দুর্নীতি রোধে কর্র্তৃপক্ষ উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।



Admin
