একুশের প্রথম শহীদ মিনারের কথা
দীপংকর গৌতম.........
উনিশশো বায়ান্নো সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষার জন্য যে স্থানে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন রফিক উদ্দিন, সেখানেই ২৩ ফেব্রুয়ারি এক রাতের মধ্যে গড়ে ওঠে বাংলাদেশের প্রথম শহীদ মিনার। ভাষা সংগ্রামী ও জাতীয় অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন ২১ তারিখের পর ২২, ২৩ তারিখেও শহরময় গোলমাল চলছিল।
এরমধ্যে মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা পরিকল্পনা করেছিলেন, একুশের প্রথম শহীদ যেখানে শাহাদত বরণ করেছেন, রফিক উদ্দিন, সেখানে তারা একটি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করবেন। এরপরই পরিকল্পনা ও নকশা এবং নির্মাণকাজ শুরু হয়। শহীদ মিনার স্থাপনের পরিকল্পনা ও নকশা নিয়ে সাঈদ হায়দার ২০১৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি একটি দৈনিকের এক নিবন্ধে লিখেছিলেন, ২৩ ফেব্রুয়ারি দিনটি ছিল অপেক্ষাকৃত শান্ত; শ্রান্তি নিরসনের। তিনি আরও লিখেছিলেন, ‘তবে এখানে-ওখানে ছোটখাটো জটলা-আন্দোলন এগিয়ে নিতে আর কী করা যায়, তারই আলোচনা। ...সামনে এলো একটা প্রস্তাব, শহীদদের শেষকৃত্য যখন আমাদের করতে দিল না, তাহলে তাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমাদের হোস্টেল অঙ্গনেই একটা স্মৃতিস্তম্ভ বানাই না কেন? ঠিক হলো যে শোরগোল করে নয়, যথাসম্ভব নীরবে-নিভৃতে ২৩ ফেব্রুয়ারির এক রাতেই নির্মাণকাজটি সমাধা করতে হবে। নকশা আঁকার ভার দেয়া হয়েছিল বদরুল আলমের ওপর। এ কাজে তার দক্ষতা ও সক্ষমতা দুই-ই ছিল। সে যে নকশা নিয়ে আসে, শৈল্পিক ব্যঞ্জনায় তা অতীব সুন্দর; কিন্তু দুটি বাঁক থাকায় ঢালাইয়ের প্রয়োজন হবে বলে একরাতে শেষ করা যাবে না। এই পরিস্থিতিতেই আমি জড়িয় পড়ি কাজটার সঙ্গে। আমি একটা মোটামুটি নকশা (এঁকে) দেখালাম বরুকে (বদরুল আলমের ডাকনাম)। ...এই সহজ-সরল প্লানটা শুধু ইট-সিমেন্টেই শেষ হবে বলে সহজসাধ্য। বদরুল আলম বরুরও পছন্দ হলো।
আমরা উভয় চূড়ান্ত ড্রয়িংটা শেষ করে নিয়ে এলে ছাত্র ইউনিয়নের নেতারাসহ ছাত্রকর্মী সবারই পছন্দ হয়’, লিখেছেন মি. হায়দার। প্রথম শহীদ মিনারটি ছিল ১০ ফুট উঁচু আর ছয় ফুট চওড়া। সাঈদ হায়দার লিখেছিলেন, ‘ছাত্র ইউনিয়নের জেনারেল সেক্রেটারি জিএস শরফুদ্দিনের ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপ্লোমা ছিল, তার সার্বিক তত্ত্বাবধানেই নির্মাণকাজ আরম্ভ হয়। দিনেই নির্মাণের স্থানটা নির্বাচিত হয়েছিল ১২ নম্বর শেডের ছাত্র হোস্টেলের (ব্যারাকের) পাশে, ছাত্রাবাসের নিজস্ব রাস্তার পাশে, যেখানে গুলিতে নিহত হয় প্রথম ভাষা শহীদ। মাত্র একজন পারদর্শী রাজমিস্ত্রির কুশলী হাতে নকশা মোতাবেক কাজ শুরু হলো, মিস্ত্রির একজন হেলপার ছিল বটে। কিন্তু আমাদের ছাত্রকর্মীরাই তো সেদিন সবচেয়ে সক্রিয় জোগালে (সহকারী)। মাত্র কয়েক মিনিটেই আল হাসিম ও মনজুরের সবল হাতে কোদালের কোপে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পাঁচ ফুট গভীর মাটি কাটা শেষ হলো।’
অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘পিয়ারু সরদার সেখানে কন্ট্রাক্টর ছিলেন, তার একটা গুদাম ছিল। সেখান থেকেই মালামাল নিয়ে ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে রাতারাতি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হয়। কলেজ ভবন সম্প্রসারণের জন্য সেখানে স্তূপাকারে রক্ষিত ইট ছাত্ররাই লাইনে দাঁড়িয়ে হাতে হাতে নিয়ে এলো, বালু আর বস্তাভরা সিমেন্ট এলো ছাত্রকর্মী আসগরের তৎপরতায় কন্ট্রাক্টর পিয়ারু সরদারের স্বতঃস্ফূর্ত বদান্যতায়। হোস্টেল প্রাঙ্গণে নানা স্থানে অবস্থিত ট্যাপ থেকে বালতিতে করে পানি বয়ে এনেছে ছাত্ররাই। তারাই ইট ভিজিয়েছে, বালু-সিমেন্টের মর্টার বানিয়েছে, নির্মাণ সামগ্রী মিস্ত্রির হাতের নাগালে পৌঁছে দিয়েছে। ব্যারাকবাসী সব বিদ্যার্থীই নির্মাণকাজে হাত লাগিয়েছিল। যে কারণে দ্রুত গড়ে উঠেছিল ভাষা শহীদদের স্মরণে প্রথম শহীদ মিনার। প্রথম ‘শহীদ মিনার’-এর গায়ে সাঁটা কাগজের ফলকে এর পরিচয় লেখা ছিল শহীদ ‘স্মৃতিস্তম্ভ’।
মিনার বলি আর স্তম্ভই বলি, এ ছিল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ক্রান্তিলগ্নে নির্মিত এক ঐতিহাসিক স্থাপনা যে পাষাণের অন্তর্নিহিত অমিতশক্তিতে ভীত হয়ে মুসলিম লীগ সরকার অচিরেই একে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে শেষ প্রস্তরখ-টিও অপসারণ করে। মাত্র তিন দিনের কম আয়ু নিয়ে এসেছিল প্রথম শহীদ মিনার। আজও স্মৃতির পটে ভেসে ওঠে শান্তি প্রিয় নিরস্ত্র সেই কয়েকজন তরুণের মুখচ্ছবি, যারা সেদিন নিজেদের মাতৃভাষার সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় ব্রতী ছিলেন বলে বৈরী সরকারের পেটুয়া বাহিনীর বুলেটের আঘাতে প্রাণ বিসর্জন দিতেও পরোয়া করেননি। আজও মানুষ জাতীয় জীবনের সমস্যা ও সংকটে, উৎসবে, আনন্দে, প্রিয়জনের চিরবিদায়ের বেদনায় শহীদ মিনারের পাদদেশেই ছুটে যায় সমাধানের প্রত্যাশায়, শান্তির অন্বেষায়। দীপংকর গৌতম, সাংবাদিক কথা সাহিত্যিক



Admin
