গ্রামের সহজ সরল মানুষদের কাইজ্যানামা, মামলানামা এবং আলতানামা
ডা. রায়হান ইসলাম শোভন.....
যখন কোথাও মারামারি হয় তখন আঘাতপ্রাপ্ত রোগী সাধারনত সরকারি হাসপাতালে আসেন চিকিৎসা এবং পাশাপাশি আইনি সহায়তা পাবার জন্য। গত বছরে ৩৬৫ দিনে মুকসুদপুর হাসপাতালে শুধুমাত্র এরকম মারামারির রোগী এসেছিল ২২১৫ জন, মানে গড়ে দিনে ৬ জন। এ বছর গত ৭৬ দিনে এসেছে ৫৫২ জন, গড়ে দিনে ৭ জনের বেশি। তো এসব রোগীর ক্ষেত্রে চিকিৎসার পাশাপাশি ডাক্তার সাহেব রোগীর শরীরের আঘাত বা ক্ষতের ধরন, সাইজ, সম্ভাব্য অস্ত্রের ধরন এসব তথ্য সরকারী রেজিস্ট্রারে লিপিবদ্ধ করে রাখেন। রোগী যদি কখনও আঘাতকারীর বিরুদ্ধে মামলা করেন তাহলে থানা বা কোর্ট থেকে সেই ডাক্তার সাহেবের নিকট সেই রোগীর জখমের বর্ননা সম্বলিত সার্টিফিকেট তলব করা হয়। অত:পর ডাক্তার সাহেব সার্টিফিকেট প্রদান করলে সেই সার্টিফিকেট এর ভিত্তিতে অপরাধ আর সাজার ধারা নির্ধারিত হয়। তাহলে দেখা যাচ্ছে সার্টিফিকেট প্রদান করা হয় মামলা দায়েরের পরে। অথচ মামলা দায়েরের সময় রোগী বা বাদি পক্ষ কে মামলার এজাহারে আসামীর নাম এবং আঘাতের ধারা উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয়। আমি জানি শহরের শিক্ষিত, জটিল আর কুটিল মানুষের কাছে কথাগুলো ফলি মাছের কাটা বেছে খাওয়ার মত কঠিন লাগতে পারে তবে এটাও জানি গ্রামের সহজ সরল অশিক্ষিত,নিরিহ মানুষ গুলোর কাছে কথা গুলো ডাল ভাতের মত সহজ লাগছে।
এবারে আসল কথায় আসি। ধরা যাক এক স্ত্রী তার স্বামী কে গোলাপ ফুল দিয়ে “আঘাত” করেছে, বিনিময়ে স্বামী করেছে হাগ্, বাংলায় যাকে বলে “জড়িয়ে ধরা”। মাসখনেক পরে হালকা দাম্পত্য কলহের জেরে ছেলের সহজ সরল মা হয়ত দেখা গেল থানায় গিয়ে এজহারে লিখবে “একমাস আগে বাশের লাঠি দিয়ে আঘাত”। প্রকৃত ঘটনা যাই থাকুক না কেন,অভিযোগ করার সময় কম করবে কোন বোকায়? বউয়ের বাবা আরো এক ডিগ্রী বেশি সরল মনের। সে ডাক্তারের কাছে গিয়ে হয়ত বলবে “আমার মেয়ের পেটে বাচ্চা ছিল,লাথি খেয়ে পড়ে গেছে”, আর থানায় গিয়ে স্বামীর বিরুদ্ধে দেবে ভ্রুন হত্যার মামলা। খেলার মাঠে ক্রিকেটের ব্যাট আর স্ট্যাম্প দিয়ে হালকা মারামারি। একপক্ষ এজহারে লিখবে হাতুরির আঘাত। অপরপক্ষ তখন পিঠ বাচাতে ব্লেড দিয়ে হালকা কেটে (ছোট বেলায় হাত কেটে ক্রাশের নাম লেখার তরিকায়) এনে বলবে রামদার কোপ। এসব বানানো গল্প না, আমাদের কাছে নেহায়েৎ নিত্য নৈমিত্তিক। তাহলে দেখা যাচ্ছে স্বাভাবিক ভাবেই এজহারের অভিযোগের সাথে ডাক্তারের সার্টিফিকেট এর কোন মিল তাল থাকে না। আর ঠিক তখন ই সেই সব দিন এনে দিন খাওয়া গরিব ভিটে মাটি হীন গ্রামের সহজ সরল মানুষ গুলো কেমনে যেন আলাদিনের চেরাগ খুজে পায়। সেই চেরাগ ঘসে তাদের হাতে আসে বান্ডিল বান্ডিল টাকা। সেই টাকা আর সহজ সরল চেহারা নিয়ে হাসপাতাল, থানা, সাংবাদিক, জনপ্রতিনিধি সহ প্রভুত দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে থাকে,”যত টাকা লাগে নেন” এই ডায়লগ দিয়ে সবাইকে কেনার চেস্টায় থাকে, কিনতে পারুক আর না পারুক চেস্টা চলতে থাকে। জনপ্রতিনিধি আর রাজনৈতিক নেতাদের কাছে গিয়ে যখন তারা ডাক্তার সাহেব কে নিয়ে অপরপক্ষ কতৃক মোটা অঙ্কের ঘুষ খেয়ে মিথ্যা সার্টিফিকেট দেবার মিথ্যা গল্প ফাদে তখন জাদরেল নেতা আর জনপ্রতিনিধিরাও সেইসব সহজ সরল ছেড়া কাপড়, মলীন চেহারা আর অশ্রুসজল নয়নের কারেন্ট জালে আটকা পড়ে। যারা ছোটবেলায় পড়েছেন গ্রামের সহজ সরল মানুষ কে গ্রামের নেতা আর জনপ্রতিনিধি রা জমিজমা, দলাদলি নিয়ে মারামারি আর মামলার ফাদে ফেলে সর্বশান্ত করে দেয় তাদের জ্ঞাতার্থে বলব একবার গ্রামে এসে কিছুদিন থেকে দেখে যান। দেখতে পাবেন, জানতে পাবেন, ধান গাছে কাঠ হয় না, আর গরুতে ডিম দেয় না। তো যেটা বলছিলাম আবেগ আর নাটকের কারেন্ট জালে আটকা পরে এবার নেতা বা জনপ্রতিনিধিরা ফোন লাগান ডাক্তার সাহেব কে। তিনি তো আর দেখেন নি আঘাত গোলাপ ফুলের না কি বাশের, কাটা টা কি ব্লেডের নাকি রাম দাও এর। রোগীর মার মুখ থেকে স্টার জলাসার ইমোশনাল ড্রামা শুনে স্বাভাবিকভাবেই মনে হবে ডাক্তার সাহেব সাক্ষাত কসাই বা ইবলিশ শয়তানের বড় ভাই। আমি ভাবি ওইসব নেতাদের জায়গায় আমি থাকলে তো ছুটে এসে ডাক্তারের টুটি চেপে ধরতাম। অথচ গত সাড়ে ৯ বছর ধরে মুকসুদপুরের জনপ্রতিনিধি আর নেতা দের দেখে আসছি। তারা কখনো এরকম সিচুয়েশনে ডাক্তার দের সাথে খারাপ ব্যাবহার করেন নি, অন্তত আমার সাথে এরকম ঘটেনি। তাদের ধৈর্য আর দুরদর্শিতার প্রসংসা করতে হয়। যাই হোক আমরা ডাক্তার রা তখন নেতা বা জনপ্রতিনিধিদের আসল ঘটনা টা বোঝানোর চেস্টা করি। যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সফল হই না। কারন যে কয় বছর বই খাতা পড়ে পড়ে একজন ডাক্তার এমবিবিএস করে বিসিএস করে সে কয় বছরে এই গ্রামের সহজ সরল মানুষ গুলো সহজতা আর সরলতার অভিনয়ের উপর পিএইচডি করে ফেলে।
গোলাপের টোকা কে বাশের আঘাত, ব্লেডের খোচাকে রাম দাও এর কোপ এই নাটক দেখতে দেখতে আমরা উপজেলার কম্পাউন্ডার রা থুক্কু ডাক্তার রা অভ্যস্ত হয়ে যাই মোটামুটি মাস ছয়েকের মধ্যে। কিন্তু আজ এমন এক অভিজ্ঞতা হল যার উদাহরণ মেলা ভার। আমার হাসপাতালের আরএমও সাহেব, জরুরী বিভাগের সামনে রাম দাও এর কোপ এ ক্ষত বিক্ষত এক নারী রোগী আর তার আত্মীয় স্বজনের গগনবিদারী চিৎকার শুনে হন্তদন্ত হয়ে রোগীর পিছে পিছে জরুরী বিভাগে ঢুকলেন। উনি জানতেন জরুরী বিভাগে ডাক্তার সহ পুরো টিম প্রস্তুত আছে নিশ্চই। কিন্তু রোগীর সিরিয়াস নেস আচ করে উন্নত সেবা নিশ্চিত করতে তিনিও হাজির হলেন জরুরী বিভাগে। হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক বলে কথা। হাসপাতালের সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করার গুরু দায়িত্ব তার ঘাড়ে। জরুরী বিভাগে ঢুকে দেখলেন রোগীনি আর তার স্বজন দের আহাজারি তে সেখানকার বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। যারা মায়ের জাত, বোনের জাতের এই হাল করেছে সে সব কুলাঙ্গারের উপর রাগ আর ঘৃনায় চোয়াল আর মুঠি দুটোই শক্ত হয়ে গেল। দায়িত্বরত চিকিৎসক কে নিয়ে ঠেলে ঠুলে রেগীর কাছে গেলেন। আঘাতের স্হান দেখে কিছুটা বিব্রত হলেন। মহিলা রোগী, হাটুর কাছে রাম দা এর কোপের কথা বলছে। অথচ সেখানের কাপড় চোপড় তথা পায়জামা অক্ষত। তাহলে কি কোপের পরে কাপড় পরিবর্তন করা হয়েছে? তাই হবে হয়ত, অন্যথায় রক্তা রক্তি অবস্হা হবার কথা। আচ্ছা দেখা যাক কি হয়। আবার বিপত্তি বাধল, রোগীনি তার ক্ষত স্হল দেখাবেন না। তাহলে ডাক্তার সাহেব দেখবেন কি আর লিখবেন কি? শেষ পর্যন্ত রোগীর আত্মীয় স্বজনের মধ্যস্ততায় সমাধান হল। কাপড় কেটে দেখা গেল সেখানে অলরেডি ব্যান্ডজ করা, মানে রোগী ব্যান্ডেজ করা অবস্হায়ই হাসপাতালে এসেছেন। নিশ্চই রক্তপাত রোধে ঘটনাস্হল থেকে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে। খুব ভাল করেছে। কিন্তু ব্যান্ডেজ খুলতে চক্ষু চড়ক গাছ। কোন কাটা নেই, ক্ষত নেই, জখম নেই। চামড়া আর ব্যান্ডেজে লেগে আছে আলতার রঙ। নিচের ছবিতে দেখুন। গত পরশু রাতের ঘটনা।মুকসুদপুরের সকল স্তরের সহজ সরল মানুষ কে রমযানুল মোবারক এবং অগ্রীম ঈদের শুভেচ্ছা। আপনারা যে ইতোমধ্যে “রমজান স্পেশাল কাইজ্যা” শুরু করে দিয়েছেন, তার ফলশ্রুতিতে আমরা গত ৬ রোজায় অলরেডি ৫৪ জন মারামারির রোগী পেয়েছি। সে জন্য আপনাদের অভিনন্দন। প্রতি ঈদের মত এই ঈদেও আমরা আপনাদের কতৃক অনুষ্ঠিতব্য ঈদ স্পেশাল কাইজ্যা”এ আহত রোগীদের সেবা দেবার জন্য অতিরিক্ত জনবল ও লজিস্টিক নিয়ে প্রস্তুত থাকব।আপনারা নিশ্চিন্তে কাইজ্যা করতে থাকেন। আমরা আপনাদের জন্য নিবেদিত আছি।
# ডা. রায়হান ইসলাম শোভন, ইউএইচএফপিও , মুকসুদপুর।



Admin
