সাঁঝের অতিথি
ইঞ্জিনিয়ার রানা মীর...................
ফিরে যাচ্ছি ১৮/১৯ বছর আগে। তখন বর্ষাকাল। খাল ছিল ভরা যৌবনা। থইথই করা পানিতে ছিল স্রোতের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। আমি গোপালগঞ্জের ছেলে। আমাদের ছোটখালে ভরা বর্ষার পানিতে তখন ভেসালে প্রচুর পরিমাণ দেশি মাছ উঠতো। আমাদের ছোট খালটায় ৩ পুরুষ ধরে ভেসাল পেতে আসছিল বনগ্রামের মনমথু কাকা। লম্বা, সুস্বাস্থ্যের কালো চেহারার এই লোকটা ছিল অত্যন্ত বড় মনের মানুষ। গ্রামের বহু দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারকে তিনি ফ্রি তে পাতিল ভরে মাছ দিতেন। বাবার সাথে মাছ কিনতে উনার নৌকাতে যাওয়া হতো মাঝেমধ্যে।
একদিন দুপুরে বাবার সাথে মাছ কিনতে উনার নৌকায় গেলাম। ভেসাল টান দিতেই অন্যান্য মাছের সাথে বিরাট একটি রুই মাছ উঠলো। তখন বিল থেকে প্রচুর মাছ নামছিল। টানে টানে মাছ। সেদিন বাবা অনেক মাছ কিনলেন। প্রথমত টাটকা, ২য় তো প্রচুর মাছ থাকায় দামেও কিছুটা সাশ্রয় ছিল। মাছ কিনে যখন নৌকা থেকে নামতে যাবো তখন মনমথু কাকা আমার হাত ধরে বসলেন। বড় রুই মাছটার মুখ ও কানে দড়ি বেধে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন এই নাও ছোটবাবু এই মাছটা তোমার।
বাবা অনেক বার বারন করার পরেও তিনি যখন নাছোড়বান্দা তখন বাবা কিছু টাকা দিতে গেলেন। তিনি বেজায় রাগ করে বসলেন। বললেন, ছেলেকে ভালবেসে একটা মাছ দিলাম। আপনি সেটারও দাম দিতে গেলেন দাদা! তার মন এতটাই খারাপ হয়েছিল যে, বাবা শেষমেশ উনার হাত ধরে ক্ষমা চেয়ে উনাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে নৌকা থেকে নামতে হয়েছিল।
এরপর কখনো কখনো গোসল করতে গেলে যেদিন প্রচুর মাছ পাওয়া যেত সেদিন মনমথু কাকা খুবই খুশি মেজাজে থাকতেন। সবার পাতিল ভরে মাছ দিতেন। একটা ব্যাগে করে প্রচুর দেশি মাছ ঢুকিয়ে আমাকে ডেকে বলতেন এই যে ছোটখোকা নৌকার কাছে আসো। গেলেই মাছ গুলো ধরিয়ে দিয়ে বলতেন মাকে বলো ভাজা রান্না করে দিতে। একেবারে দেশি টাটকা মাছ। খেয়ে মজা পাবা।
একদিন সন্ধাবেলা মাগরিবের আযানের সময় অল্প কিছু ছোট মাছ নিয়ে মনমথু কাকা আমাদের বাড়ির উঠানে এসে মাকে ডাক দিলেন। তখন টান সিজন। মাছ খুব বেশি পাওয়া যাচ্ছিল না।
মনমথু কাকা মাছ গুলো মাকে দেখিয়ে বললেন, বৌদি সারা বিকাল ভেসাল বেয়ে এই সামান্য কিছু ছোট মাছ পেয়েছি। এই দিয়ে চালডাল কিভাবে কিনবো বুঝতে পারছিনা। সবাই উপাস আছে। মা বললেন, দাদা আপনি নিশ্চয়ই দুপুরে খাননি। হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসেন আগে। দেখছি কি করা যায়। মা তাকে খেতে দিয়ে কিছুক্ষণ পরে এসে বেশ কিছু টাকা তার হাতে ধরিয়ে দিলেন। সাথে ৫/৬ কেজি চাল। মা টাকা গুলো এমনভাবে দিলেন যেন বাজারে মাছের খুবই অভাব। সে বললেন, দাদা ভালই করেছেন মাছগুলো এনে। বাজার থেকে মাছ কিনে আনার লোকই খুঁজে পাচ্ছিনা। আজকাল বাজারে মাছের যে দাম। বলতে বলতে টাকা গুলো গুজে দিলেন। একজন বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিকে তার সম্মান বজায় রেখে অভিনয় করে যে সহযোগিতা তিনি সেদিন করেছিলেন আমার দেখা এটাই ছিল শ্রেষ্ঠ, সুন্দর অভিনয়। এতবছরেও সেই চমৎকার অভিনয় ভুলিনি।
এর এক দুই বছর পর পড়াশোনার জন্য ঢাকা চলে গেলাম। একদিন ঢাকা থেকে আসতে রাত ১১ টা বাজলো। তখন বর্ষাকাল। বাড়ির রাস্তা পানির নিচে ডুবে গেছে। বনগ্রাম-টেকেরহাট সংযোগ সড়কে দাঁড়িয়ে মনমথু কাকাকে জোড়ে ডাক দিলাম। নৌকা থেকে উত্তর আসলো, কিরা ছোটবাবু নি? এক প্রকার নৌকা নিয়ে ছুটে আসলো। বললাম রাস্তায়ই নামিয়ে দিতে। সে নাছোর বান্দা, বাড়ির ঘাটেই নামিয়ে দিবে। ভেসাল রেখেই আমাকে নিয়ে আসলো বাড়ির ঘাটে। আমিও নাছোর বান্দা, জোড় করে নামিয়ে এক সাথে রাতের খাবার খেলাম।
বছর দশেক আগে কোন এক সন্ধায় মনমথু কাকা পৃথিবী নামক এই ঝামেলাময় গ্রহ থেকে চিরবিদায় নিলেন। আমি জেনেছি তারও অনেক পরে। যেদিন শুনলাম মনমথু কাকা নেই। নিজের অজান্তেই চোখ বেয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। রক্তের সম্পর্ক নেই, একজন পর মানুষের জন্য চোখে কেন জল আসবে এর ব্যাখ্যা খুঁজে দেখার দরকার মনে করিনি। শুধু এটুকুই জানি ভালবাসা তৈরী হতে রক্তের সম্পর্ক লাগেনা। ভালবাসা, টান এগুলো ভেতর থেকে আসে। এরপর অনেকবার ছোট খালে গেছি। ৩ পুরুষের বেয়ে যাওয়া ভেসালের যায়গাটা ফাঁকা দেখে বুকের ভেতরটা ধক করে উঠে। কখনো কখনো মনে হয় ছোট খালটায় গেলে নৌকাটা থেকে বেরিয়ে মনমথু কাকা বলবেন, এই যে ছোটখোকা মাছ নিয়ে যাও।
ভাবতে অবাক লাগে, রক্তের সম্পর্ক বিহীন একটা মানুষের জন্য খুব মায়া হয়। মাঝে মাঝে আমি ভিষণ কষ্ট পাই! মায়া হতে কি আদৌ রক্তের সম্পর্ক হওয়াটা ম্যান্ডেটরি ?।



Admin
