প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীর দুর্নীতি-আর্থিক কেলেঙ্কারী - যথেষ্ট হয়েছে: এখন লাগাম টানতে কঠোর কার্যকর ব্যবস্থা চাই
সাম্প্রতিক সময়জুড়ে দেশের প্রিন্ট ও ইলেক্ট্র-অনলাইন মিডিয়ার মূলধারার গণমাধ্যম সমূহে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিশেষ করে ব্যক্তি বিশেষের আর্থিক দুর্নীতির সুবিস্তার কেলেঙ্কারীর ভয়াবহ সংবাদ চিত্র প্রকাশ পাচ্ছে একাদিক্রমে; যেন দুর্নীতির সুনামীর ঢল নেমেছে। অবশ্য সারা বৎসরই দুর্নীতির সচিত্র সংবাদ প্রকাশে বরাবর শীর্ষ শিরোনামে অবস্থান করছে পাতাজুড়ে। এখন চলছে কার চেয়ে কে বেশি পরিমান করতে পেরেছে সেই হিসাব কষছে উৎসুক কৌতুহলী জনতা। র্যাব-পুলিশের সদ্যবিদায়ী সাবেক বড়কর্তা বেনজির আহমেদ এর দেশজুড়ে বাড়ি-বাগান, রিসোর্ট- খামার, ব্যাংক ব্যালেন্স এর ইত্যাদির অনুসন্ধানী তথ্য প্রকাশের মধ্য দিয়ে আম পাবলিকের নজরে এসেছেন। সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের দেশে প্রবেশে পরিবারসহ নিষেধাজ্ঞা দিয়ে অভিযোগের পালে জোর হাওয়া লাগিয়েছে। এর পরেই ঈদুল আযহার কোরবানীর পশু কিনতে গিয়ে ১৯ বছরের যুবক সাদিক এগ্রোর দাম হাঁকানো ১৫ লাখ টাকার ছাগল কিনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমজুড়ে ভাইরাল হওয়া মুশফিকুর রহমান ইফাত যোগ্য সন্তান হিসেবে আলোচনায় শীর্ষ স্থান পেলেও কৌতুহলী দুষ্ট অনুসন্ধানে পিতা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টমস, এক্সাইজ, ভ্যাট আপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট মতিউর রহমানের অর্থ-বিত্ত সম্পদ হিসাবের জারিজুরি সব প্রকাশ হয়ে পড়ে। পাঁকে পড়ে শেষতক সন্তান ইফাতকে অস্বীকার করেও নিস্তার পারছেন না, বৈরি বাতাসের গরমে তেমনটাই অনুমিত হচ্ছে। কার্যত এসব অর্থকড়ি অবৈধ; কারণ কোন ব্যক্তির পক্ষে এক জীবন দূরের কথা শত জীবন চাকরি করেও বৈধভাবে এত পরিমান বিত্তবেসাত অর্র্জন করা সম্ভব নয়। শুধু কি বেনজির-মতিউর, তা কিন্তু নয়, পুলিশের সাবেক ও বর্তমান অনেক বড় কর্মকর্তাদের আর্থিক দুর্নীতির তথ্যাদিসহ প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীর দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ পাচ্ছে প্রতিনিয়ত। সব মিলে দুর্নীতির মহোৎসবের চিত্র প্রকশ হওয়ায় কিছুটা হলেও সরকার বিব্রত; জনগণ হতবাক। এ কেমন দেশ! সরকার আছেন, নিবেদিত রাজনীতির নেতা-কর্মী আছেন, আছে মাথাভারী প্রশাসনযন্ত্র। সবার প্রচেষ্টাই কী বিফলে যাচ্ছে; এই প্রশ্ন এখন আমজনতার।
বাংলাদেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় সমাজ দুর্নীতিগ্রস্ত। স্বাধীনতার পূর্ব থেকেই উত্তরাধিকার সূত্রে কিছুটা, বাকীটা এসেছে ব্যক্তির দুর্বুদ্ধির কলাকৌশলের চর্চায়; বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক পালাবদল উপাখ্যানের বদৌলতে প্রাপ্ত সুযোগে দলবাজীর সদ্যব্যহার, সুবিধাবাদীদের জন্য এটা শৈল্পিক রীতি। এত কিছুর পরেও বলতে হবে সবাই দুর্নীীতগ্রস্ত নয়, মানুষ মাত্রই পার্থক্যÑ পরিবার, রুচি, শিক্ষা-সংস্কৃতির আবহে গঠিত চারিত্রিক বৈশিষ্ঠ্যে। তথাপি হালে দুর্নীতিগ্রস্তদের সংখ্যাটা এতটাই বাড়ন্ত যে ‘সৎ’ খুঁজে পাওয়া বিরল। শুধুমাত্র প্রাজাতন্ত্রের কর্মকর্তা কর্মচারীদের মধ্যেই দুর্নীতি ছড়িয়েছে তা নয়, ব্যবসায়ী, স্বেচ্ছাসেবী, সংগঠিত-ব্যক্তি পর্যায়ে সাধারণ জনগণের কর্মতৎপরতার মধ্যেও দুর্নীতির করাল গ্রাস খামচে ধরেছে। তবে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা কর্মচারীর দায়বদ্ধতার অবস্থান থেকে দুর্নীতির আশ্রয় গর্হিত ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলেও বলতে হবে প্রশাসনযন্ত্রে দুর্নীতি সর্বব্যপ্ত; দুর্নীতি রন্ধ্রে শিরায় ছড়িয়ে পড়েছে ক্যানসার ব্যাধির মত। জনসেবায় সম্পৃক্ত সকল বিভাগেই দুর্নীতির কালো থাবা সচল সক্রিয়। স্তর ভেদে দুর্নীতির চিত্র ও মাত্রা হয়তো ভিন্ন হতে পারে। কোথাও এটা বখশিশ, কোথাও খুশি করা, কোথাও পারসেন্টেজ, কোথাও কনট্রাক্ট ড্রিল, ইত্যাদি রকমফের আছে। বস্তুত সবার না হোক কারো কারো সরকারী চকুরীতে বেতন না হলেও অশুবিধা হওয়ার কথা নয় কারণ সাধারণের ক্ষেত্রেই বেতন থেকে উপরি বেশি, মাসিক পঞ্চাশ হাজার হলে তাদের দৈনন্দিন বাজার খরচা পাঁচ থেকে দশ হাজার অর্থাৎ দেড়-দুই লাখ টাকা। পঞ্চাশ হাজার টাকার হিসাবের সময় মাসে দশ হাজার টাকা লিখলেই হিসাব মহাসঠিক; অসাধারণের বেলায় এর কোন তুলনা চলে না। ফলে দুর্নীতির এই চিত্র ধরা পড়ে না, ধরা পড়বে ব্যাংক ব্যালেন্স, বাড়ি-গাড়ি, জমি-জিরাত, আর্থিক লগ্নিসহ ব্যবসা-বিনিয়োগের প্রামাণ্য দালিলিক সূত্রে।
দুর্নীতি রোধে অনুসন্ধান-তদন্ত, মামলা-বিচার প্রক্রিয়ায় আইনী ক্ষমতায় কার্যকর একমাত্র দুর্নীতি দমন কমিশন। কিন্তু বিপুলব্যাপ্ত দুর্নীতির খোঁজ খবর করতে একটা কেন দশটা কমিশনের পক্ষেও সম্ভব নয়। কমিশনের কার্যক্রমে দুর্নীতির অনসন্ধান-তদন্ত, মামলা-বিচার এর সমুদয় প্রক্রিয়া যথেষ্ট সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। ফলে মনে হতে পারে কমিশনেও কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। অন্যদিকে প্রশাসনযন্ত্রে বিভাগীয় ব্যবস্থা থাকলেও অবস্থা দৃষ্টে সীমিত, অকার্যকর। এখন প্রয়োজন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ; প্রয়োজনে প্রশাসনিক ক্ষমতায় আন্তঃ মন্ত্রণালয় সমন্বয়ে ঊচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন টাস্ক ফোস গঠন। এর অধীনে বিশেষ বিশেষ সেল গঠন করে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত স্থাপন করা, যারা দুর্নীতি সংঘটনের তথ্য উপাত্য সংগ্রহ করে টাস্কফোর্স কেন্দ্রে প্রেরণ করবেন। কেন্দ্র যাচাই-বাছাই করে তাৎক্ষণিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং অনুসন্ধান-তদন্ত কার্যক্রমের মাধ্যমে মামলা-বিচার প্রক্রিয়ায় নিষ্পন্ন করতে উপযুক্ত বিভাগকে নথি প্রেরণসহ নির্দেশনা দিবেন। কার্যত প্রচলিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি দমনে সংক্ষিপ্ত ব্যবস্থা পদ্ধতি আদৌ নেই। ফলে নতুনতর ভাবনাই দুর্নীতি থেকে রেহাই পেতে পথ দেখাতে পারে। গণতান্ত্রিক মুক্ত স্বাধীনতা, পুঁজিবাদী অর্থনীতির উন্মুক্ততার জয়গান, শ্রেষ্ঠত্ব-মহত্বের ফাঁক ফোকর দিয়ে দুর্নীতির কালো বিড়াল, ইঁদুর, সংগোপনে হাতি হয়ে যাচ্ছে। সবার প্রশ্ন এর প্রতীকার কী, উপায়ই বা কী। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন দেশ, মুক্তিযুদ্ধে চেতনায় আশাজাগানিয়া সম্ভাাবনাময় স্বদেশ আজ দুর্নীতিসহ নানাবিধ জঞ্জাল পাঁকে নিমজ্জিত। আমাদের কি মুক্তির পথ খোলা নেই।



Admin
