উপজেলা নির্বাচন ও কয়েকটি কথা

উপজেলা নির্বাচন ও কয়েকটি কথা

জাহিদ রহমান.........

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে নৌকার কষ্টার্জিত বিজয় হয়। বিজয়ের পরেও আওয়ামী পরিবারের অনেক কিছু ভাববার ছিল, বুঝবার ছিল এবং নিজেদের সংশোধন করার ছিল। এমনকি যাদের লেখার অভ্যাস, তাঁদের অনেক কিছু লেখার ছিল। কিন্তু কেউ লিখেননি, আমিও না। রবি ঠাকুর বলেছেন-সহজ কথা কইতে আমায় কহ যে/ সহজ কথা বলা যায় না সহজে। কারন লেখার ক্ষেত্রে পরিস্থিতিতে নিজের মধ্যে সেল্ফ সেন্সরসীপ চলে আসে। এর পেছনেও কারন আছে। সম্প্রতি প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মন্তব্য করছেন - আমাদের দেশের মানুষ চাকরি হারানোর ভয়ে কথা বলেনা, এটা সমাজ, প্রতিষ্ঠান, দল ও দেশ সবকিছুর জন্য ক্ষতিকর।

শুধু পার্শ্ববর্তী উপজেলার আওয়ামী লীগের একজন নিবেদিত কর্মী সাহেব ফকির এর একটি নির্বাচনের কথা স্মরণ করবো। যে নির্বাচনে তাঁকে দল থেকে নৌকা প্রতীক দেয়া হলেও শোনা যায়- অসুস্থ নেত্রীর প্রতিনিধি নীতিনির্ধারক অন্য প্রার্থীকে সমর্থন দেন। ওই নির্বাচনে জনাব সাহেব ফকির পরাজিত হন। বিধির বিধান - আজ তিনি নির্বাচিত চেয়ারম্যান। তিনি আজও দলের সাথে, জনগণের সাথে আছেন। ওই নীতিনির্ধারক জনগণের সাথে আছেন কি-না জানিনা।

২১ মে অনুষ্ঠিত মুকসুদপুর উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে সাবেক চেয়ারম্যান কাবির মিয়া পুনরায় নির্বাচিত হয়েছেন।

তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী এমএম মহিউদ্দিন আহাম্মেদ মুক্ত প্রায় এগারো হাজারের বেশি ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছেন। তৃতীয় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী আবুল কাশেম রাজ নির্বাচন চলাকালীন সময়ে ব্যাপকভাবে আলোচনায় থাকলেও বিজয়ী প্রার্থীর অর্ধেকের কিছু বেশি ভোট পেয়েছেন। তবে ভোটাররা মনে করছেন - নতুন প্রার্থী হিসেবে তাঁর প্রাপ্ত ভোট নেহায়েত কম নয়।

আবুল কাশেম রাজ এর প্রাপ্ত ভোট সংখ্যা আটাশ হাজারের কিছু বেশি। সংখ্যার হিসেবে বিজয়ী প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের অর্ধেক এবং দ্বিতীয় প্রার্থীর সাথে প্রায় চৌদ্দ হাজারের ব্যবধান।

সংখ্যা তত্ত্বের হিসাবে এ ভোট সংখা অনেক বড় কিছু মনে না হলেও মুকসুদপুরের পরবর্তী রাজনীতিতে এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে তা সহজেই অনুমেয়। এই আটাশ হাজার ভোট নির্বাচনের ফলাফল ও এ এলাকায় নির্বাচন পরবর্তী রাজনীতির অনেক সমীকরণ পাল্টে দিয়েছে এবং দিবে বলে অনেকে মনে করছেন। তারা মনে করছেন পরাজিত দুই প্রার্থীর প্রাপ্ত সত্তর হাজারের বেশি ভোট আওয়ামী শিবিরের ভোট।

উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে কোনো প্রার্থী দেয়নি।

দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ এলাকার আওয়ামী পরিবারের অভিভাবক মাননীয় মন্ত্রী মুহাম্মদ ফারুক খান এমপিও প্রত্যক্ষভাবে কোন প্রার্থীকে সমর্থন দেননি। ফলে উন্মুক্ত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মূলত এ দুই প্রার্থীর সাথে বিভক্ত হয়ে নির্বাচন করেন। উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ দলের অধিকাংশ নেতাকর্মী মুকসুদপুর আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের কর্মী এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন আহাম্মেদ মুক্ত মুন্সীর সাথে থাকেন এবং একটা অংশ বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ইয়াং ও স্মার্ট প্রার্থী হিসেবে আবুল কাশেম রাজ এর সাথে থাকেন। ফলে আওয়ামী শিবির এ নির্বাচনে কিছুটা বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং তৃণমূল কর্মীরা পড়েন মহা বিপাকে। অনেকে মনে করছেন এভাবে ভোট দুইভাগ না হয়ে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ একজনকে নিয়ে নির্বাচনের মাঠে নামলে তাদের প্রার্থীকে বিজয়ী করতে পারতো।

এছাড়াও নির্বাচন পরবর্তীতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের যা মনোভাব প্রকাশ করতে দেখা যাচ্ছে তা আওয়ামী শিবিরে বিভক্ত ও বিভাজনের স্পষ্ট ঈঙ্গিত বহন করে। এ অবস্থা সামনে আওয়ামী লীগের রাজনীতির জন্য কতটা কল্যাণকর হবে তা সময় বলে দিবে। কারন আওয়ামী শিবির সমর্থিত দুই প্রার্থীর কোনো প্রার্থী বিজয়ী না হওয়ায় আওয়ামী আদর্শের কর্মীরা একটি আদর্শিক ধাক্কা খেয়েছেন, অনেকে অনেককে দোষারোপ করছেন। আবেগী অনেক কর্মী তাদের আবেগ, অসন্তোষ ধরে রাখতে না পেরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু অনাকাক্সিক্ষত শব্দ চয়ন করে ফেলছেন; যা আওয়ামী লীগের বিভাজনকে ত্বরান্বিত করতে পারে বলে বিভিন্ন জায়গায় আলোচনা হচ্ছে।

এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের অভিভাবক মাননীয় মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতৃবৃন্দের সময়োপযোগী এবং সঠিক সিদ্ধান্ত ও কর্মপন্থা নির্ধারণ করা জরুরী। নচেৎ এ উপজেলায় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক ভীত ক্রমশ: দুর্বল হবে।

একসময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা হুজ্জাত হোসেন লিটু অভিমান করে প্রায় তিন দশকেরও বেশি সময় মুজিবকোট হ্যাংগারে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন।

আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতৃবৃন্দ এসময়ে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে এবার না জানি কতো মুজিবাদর্শের সৈনিক মুজিবকোট হ্যাংগারে ঝোলাবে তা একমাত্র সময়ই বলে দিবে।

যাহোক, জাতীয় নির্বাচনের পর আমি কবি কায়কোবাদ এর প্রভু ভুল ভেঙে দাও ‘ কবিতাটি ফেসবুকে স্ট্যাটাস হিসেবে দিয়েছিলাম। নিজের আবেগ নিজের মধ্যে গুমরে মরুক। আজও অন্য একজন কবি তারাপদ রায়ের একটি কবিতার শেষ দুটি লাইন এখানে উল্লেখ করতে চাই -

আমরা টের পাইনি/ আমরা বুঝতে পারিনি/ আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে।

 

পূণশ্চঃ মুকসুদপুর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী প্রার্থী দেখা করলেন বিজিত দুই প্রার্থীর সাথে। বিজিত প্রার্থীদ্বয় যেভাবে স্বতঃস্ফূর্ত সাক্ষাৎ ও মোলাকাত করলেন তা অভাবনীয়। বিজয়ী চেয়ারম্যান যেমন কালক্ষেপণ না করে বিজিতদের সাথে সাক্ষাৎ করতে দ্বিধা করেননি, ঠিক তেমনই বিজিত প্রার্থীদ্বয় কোনরকম ব্লেম গেইম না খেলে পরাজয় স্বীকার করে জনগণের ম্যান্ডেটকে সম্মান করেছেন। এটাই রাজনীতির সৌন্দর্য, গণতান্ত্রিক এক পজিটিভ রীতি। সকল প্রার্থীর কর্মী সমর্থকদের মধ্যেও রাজনীতির এ উদার চর্চা থাকলে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব।

নির্বাচনে জয়-পরাজয় আছে, এটা স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়ে তিন প্রার্থীর এহেন গণতান্ত্রিক ও সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ সকল প্রার্থীর কর্মী সমর্থকদের স্বস্তি দিবে এবং সমগ্র উপজেলায় শান্তি বজায় রাখতে অনন্য অবদান রাখবে বলে মনে করি। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের এমন সৌহার্দপূর্ণ আচরণের পরেও কোনো অপরাজনীতির যাতাকলে কোনো প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের না পড়তে হয়- সে প্রত্যাশা করছি। # জাহিদ রহমান, শিক্ষক, রাজনীতিক।