নৌকা ঈগলে সরগরম নির্বাচনের মাঠ

নৌকা ঈগলে সরগরম নির্বাচনের মাঠ

------------- হায়দার হোসেন -----------

দীর্ঘ দিনের পরীক্ষিত আওয়ামী ভোট ব্যাংক খ্যাত গোপালগঞ্জ-১ আসন এবার নৌকার জয়লাভ প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়েছে। জাতীয়ভাবে বিএনপি ভোটে না থাকায় ক্ষমতাশীন আওয়ামী লীগ ও সরকার দলীয় নেতা কর্মীদের জন্য নৌকা প্রতীকের বাইরে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ কিংবা স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে উš§ুক্ত করে দেয়ায় দেশজুড়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অংশ গ্রহণ উল্লেখযোগ্যভাবে দৃশ্যমান। গোপালগঞ্জ-১ মুকসুদপুর-কাশিয়ানী আসনে আওয়ামী লীগ থেকে যারা মনোনয়ন সংগ্রহ করেছিলেন দলীয় মনোনয়ন বঞ্ছিত মো. কাবির মিয়া স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করছেন। বাকীরা নিদেজের পছন্দ মতো নৌকার পক্ষে কিংবা স্বতন্ত্র প্রার্থীর ঈগলে নির্বাচনী ক্যম্পেইন করছেন। এ কারণে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মুহাম্মদ ফারুক খান দীর্ঘ দিনের ভোট ব্যাংক এলাকার ফাঁকা মাঠে বিজয়ী হওয়া দুস্কর হয়ে পড়েছে। দলের প্রার্থীকে জয়লাভের জন্য দুই উপজেলার (মুকসুদপুর - কাশিয়ানি) আওয়ামী লীগ, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ, সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দকে এবার কোমর বেঁধে নামতে হয়েছে।

 অপরদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী কাবির মিয়া কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক উপ কমিটির সাবেক সদস্য, মুকসুদপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করে ঈগল প্রতীকে নির্বাচন করছেন। পৌরসভায় তার নিবাস এবং স্থানীয়ভাবে সুপরিচিত হওয়ায় তার কর্মী সমর্থক এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে আছে। ফলে নির্বাচনে তিনি মাঠ সরগরম করেছেন। বলা যায় আওয়ামী লীগের বিপক্ষে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বিতা, কেননা আওয়ামী লীগের বাইরে গোপালগঞ্জ জেলার বাকী দুই আসনের মতোই অন্য কোন দলের সাংগঠনিক অবস্থান বা কারচুপিমুক্ত নির্বাচনী বিজয় এখনো অসম্ভব বাস্তবতা। নিকট অতীতের ইতিহাস এর উদাহরণ।

১৯৯৬ সাল থেকে ২০১৮ পর্যন্ত সকল জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, মুহাম্মদ ফারুক খান পক্ষে ফলাফল দেশের মধ্যে ঈর্ষণীয়। এবারও দলীয় মনোনয়ন বোর্ডের সিদ্ধান্তে ৬ষ্ঠ বারের মতো তিনি মনোনীত হয়েছেন।

১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত ৭ম সংসদ নির্বাচনে গোপালগঞ্জ-১ আসনে মোট ভোটার ছিল ১ লাখ ৮৭ হাজার ৩ শ ৫০। ওই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াতে ইসলামী’র দাড়িপাল্লা প্রতীকে ৫ হাজার ২শ ৩৬ ভোট পেয়েছিলেন। অপরদেকে নৌকা প্রতীকে মুহাম্মদ ফারুক খান ১ লাখ ১৯ হাজার ৫শ ৩৬ ভোটে প্রথম জয় যুক্ত হন। ওই সময় ভোটের ব্যবধান ছিল ১ লাখ ১৪ হাজার ৩শ ভোট। ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত ৮ম সংসদ নির্বাচনে মুহাম্মদ ফারুক খান নৌকা মার্কায় পেয়েছিলেন ১ লাখ ৪৫ হাজার ৩শ ৯১ ভোট। অপরদিকে ওই সময়ের হেভিওয়েট বিএনপি প্রার্থী মহব্বত জান চৌধুরী পেয়েছিলেন ২০ হাজার ১শ ৩৬ ভোট।

২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত ৯ম সংসদ নির্বাচনে ২ লাখ ৪২ হাজার ১শ ৫২ মোট ভোটার এর মধ্যে মুহাম্মদ ফারুক খান পেয়েছিলেন ১ লাখ ৮৩ হাজার ২শ ৩৭ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি’র সেলিমুজ্জামান মোল্যা পেয়েছিলেন ৯ হাজার ৯শ ৮৬ ভোট। ২০১৪ সালে ১০ম সংসদ নির্বাচনে ২ লাখ ৭৬ হাজার ৫শ ৭৬ ভোটের মধ্যে মুহাম্মদ ফারুক খান আওয়ামী লীগ প্রার্থী হয়ে নৌকা প্রতীকে ২ লাখ ৪০ হাজার ৩শ ৪ ভোট পেয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির দীপা মজুমদার পেয়েছিলেন ৫ হাজার ৮শ ৬৩ ভোট। সর্বশেষ ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন মোট ৩ লাখ ২১ হাজার ১শ ৩০ ভোট, আর ছিল ৪ প্রার্থী। সেখানে নৌকা মার্কায় ভোট পেয়েছিল ৩ লাখ ৩ হাজার ১ শ ৬২ আর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ প্রার্থী (হাতপাখা) মোহাম্মাদ মিজানুর রহমান পেয়েছিলেন ৭শ ২ ভোট।

এবারে মুকসুদপুর ও কাশিয়ানী এলাকায় ১ পৌরসভা ২৩ ইউনিয়নে মোট ভোটকেন্দ্র ১শ ৩৮টি। মোট ৩ লাখ ৭৪ হাজার ৫শ ৯০ ভোটার রয়েছেন। দু উপজেলার নেতা কর্মীদের দাবি এবারও অতীতের ইতিহাসের সাথে মিল রেখে ভোট প্রাপ্তিতে নতুন ইতিহাস গড়বেন।

এজন্য তার নির্বাচনী এলাকার তৃণমূল পর্যায়ের সকল নেতাকর্মীরা ভোটের মাঠে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন। উন্নয়নের ফিরিস্তি প্রচার করছেন, নিজেদের দোষত্রুটি থাকলে তার জন্য অনুতপ্ত হওয়াসহ ক্ষমা প্রার্থনা করছেন।

বিপরীতে ভোট ব্যাংক থাকলেও দীর্ঘ ১৫ বছর দল ক্ষমতা থাকায় কিছু কিছু নেতা কর্মীর আচার-আচরণ সাধারণ জনমতের বিপক্ষে যাওয়ার কারণ। দলের কিছু নেতৃত্ব ঘনিষ্ট নেতা-কর্মীর বিতর্কিত ভূমিকা, কর্মকা-ের জন্য ফারুক খানের পক্ষের সাধারণ মানুষ বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। অপরদিকে গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলের মনোনয়ন না পেয়ে কিছু লোক দল থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। আবার যারা নৌকার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কয়েকটি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ প্রার্থী পরাজিত হয়েছে, বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে অল্প ভোটের ব্যবধানে পরাজয় বরণকারি স্বতন্ত্র প্রার্থীরা এবার একজোটে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কাবির মিয়ার পক্ষে শক্তি নিয়োগ করছে। দুএকজন সরকারি শীর্ষ আমলা অবসরে এসে নৌকা বিরোধী কার্যক্রমে পুরোদমে নেমে গেছেন। তাদের একজন বীরমুক্তিযোদ্ধা রুস্তুম আলী মোল্যা।

কেন্দ্রীয় যুবলীগের শিক্ষা প্রশিক্ষণ ও পাঠাগার সম্পাদক ব্যারিষ্টার আলী আসিফ খান রাজীব। তিনিও মনোয়ন প্রত্যাশী ছিলেন। যুবলীগের কেন্দ্রীয় চেয়ারম্যান শেখ ফজলে সামস পরশের নির্দেশে যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন নিখিল স্বাক্ষরিত চিঠিতে নৌকা প্রতীকের নির্বাচন করার নির্দেশনা দিলেও তিনি এলাকায় আসেন না। তার চাচাকে নৌকা বিরোধী সভা সমাবেশ ও ক্যাম্পেইনে অংশ নিতে দেখা যাচ্ছে। এভাবে সংরক্ষিত আসনের মহিলা এমপি নার্গিস রহমান এলাকায় নৌকার প্রচারণায় নেই। তার আপন ভাই সানোয়ার লস্কর ও তার স্ত্রী কানিজ ফাতেমা মালা ঢাকা মহানগরের ডাকসাইটে নেত্রী। তারা দুজনই নৌকার বিপক্ষে কাবির মিয়ার অফিস খুলে তার নিকটজনদের নিয়ে ক্যাম্পেইন করে যাচ্ছেন। ননীক্ষির ইউনিয়নের নৌকার প্রতীকে পরাজয় বরণ করেছেন মজিবুর রহমান শেখ। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থীর জন্য প্রতিদিন বিপুল পরিমান খাবার তৈরী করে স্বতন্ত্র প্রার্থী কাবির মিয়ার পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন। কাশিয়ানি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সুব্রত ঠাকুর হিটলুও ছিলেন গোপালগঞ্জ-১ আসনের নৌকা প্রতীক প্রার্থী। তিনি তার এলাকার আংশিক (৭ ইউনিয়নে) স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মীদের সমর্থন দেওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আতিকুর রহমান মিয়াও নৌকা প্রতীক নিয়ে এমপি হতে চেয়েছিলেন, বর্তমানে অসুস্থ থাকায় তার জামাতা ও ভাতিজা কাবির মিয়ার পক্ষে সমর্থন দিয়েছেন। তার দু’ছেলে কাবির মিয়ার পক্ষে প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছেন।

সাবেক এমপি কাজী আবদুর রশিদের সন্তান কাজী হারুন অর রশিদ মিরন। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক মন্ডলীর নেতা। তিনি নৌকার মনোনয়ন না পেয়ে আক্ষেপ শেষে শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তকে চুড়ান্ত নির্দেশনা মনে করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্টাটাস দিয়ে ফারুক খানের প্রচারণায় নেমে পড়েছেন।

এছাড়া এবারের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শক্তিশালী মনোনয়ন প্রার্থী ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটির সদস্য ও অগ্রণী ব্যাংকের পরিচালক খন্দকার মঞ্জুরুল হক লাবলু। গত ১০ বছর নানাবিধ ক্যাম্পেইন করেছেন তিনি। তার ক্যম্পেইনে প্রধান সমন্বয়ক ছিলেন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কাবির মিয়া। তিনি মনোনয়ন না পেয়ে কাবির মিয়াকে সমর্থন দিয়েছেন। লাবলুর ঘনিষ্টজনেরা প্রকাশ্যেই কাবির মিয়ার পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন। এজন্য সব স্তরে কাবির মিয়ার সাংগঠনিক কর্মকা- না থাকলেও সম্মিলিত বিরোধীরা এক হয়েছে বলা যায়। আর এ কারণে নৌকা প্রতীকের জন্য চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে।  এবারে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় পদপদবী থাকার পরও জেলা উপজেলা পর্যায়ের কয়েকজন নেতা নৌকার বিপক্ষে প্রচার প্রচারণায় দেখা গেছে। তাদের মধ্যে জেলা কমিটির নেতা আশরাফ আলী আশু মিয়া, উপজেলা কমিটির সম্পাদক ম-লির সদস্য আশিকুর রহমান রনি, সদস্য হাফিজুর রহমান লেবু ও কাজী ওহিদুল ইসলাম আছেন।

সবমিলিয়ে মনোনয়ন না পেয়ে অভিমানী, দলের নেতা হতে না পারা, দলের দীর্ঘদিনের পদ থেকে অব্যহতি পাওয়া, দলের কোনঠাসা হয়ে যাওয়া, দল থেকে সুবিধা না পাওয়া এবং ভোটে না আসা দলের নেতাকর্মী সমর্থকরা ভোটের মাঠকে সরগরম করে তুলছে। এ কারণে কেউ কেউ বলতে শুরু করেছেন যে নৌকার ভোট ব্যাংক এর রিজার্ভ একটু কমেছে বা কমতে শুরু করেছে।

মোটা দাগে বলা যায় দু’উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা কর্মী সমর্থকরা দিনরাত নৌকা তথা মুহাম্মদ ফারুক খানের পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন।

সব মিলিয়ে একথা স্পষ্ট যে ভোট হচ্ছে এবার উৎসব মুখর, প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভরপুর। নৌকা ঈগলের বাইরে অন্য প্রার্থী থাকলেও তাদের সরব পদচারণা অনুপস্থিত। লাঙ্গল প্রতীকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী শহিদুল ইসলাম, সোনালী আঁশ প্রতীকে তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী মো.জাহিদুল ইসলাম এবং আম প্রতীকে এনপিপি’র প্রার্থী শেখ মো.আবদুল্লাহর নির্বাচনী প্রচারণায় এলাকায় পোষ্টার টানানো ছাড়া তেমনটা দৃশ্যমান নয়। বলা যেতে পারে তারা নির্বাচনে নামমাত্র অংশ নিয়েছেন। যোগাযোগের অনাগ্রহে খোঁজ করেও তাদের প্রতিক্রিয়া জানা সম্ভব হয়নি।