গ্রামীণ সাংবাদিকদের উন্মেষ বিকাশ ও সংকট

গ্রামীণ সাংবাদিকদের উন্মেষ বিকাশ ও সংকট

প্রফেসর নীরদ মজুমদার

আমাদের দেশে সাংবাদিকতা বিকাশের ইতিহাস খুব প্রাচীন না হলেও তাম্রলিপি, পাতার পত্র, ছাল বাকলে সংবাদ প্রেরণের ইতিহাস আছে। এ অঞ্চলে মনুষ্য বসতির সঠিক ইতিহাস বলা কঠিন। দুই আড়াই হাজার পূর্বে তো হবেই। আফ্রিকা থেকে সুদান হয়ে মনুষ্যজাতি গয়ার (ভারত) দিকে এসে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। মনুষ্য বসতির সাথে সাথে খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, খবর দেওয়া নেওয়া কাজের প্রসার ঘটে এই অষ্টাদশ শতাব্দীর দিকে। আমাদের দেশ ব্রিটিশ আমলে অনেক পত্রিকা, ম্যাগাজিন, প্রকাশিত হলেও বাংলাদেশের এ অঞ্চলে সংবাদপত্রের বিকাশ একেবারে সম্ভব হয়নি। সবচেয়ে কঠিন বাস্তবতা বড় বড় শহরকেন্দ্রিক ২/৪টা পত্রিকা প্রকাশিত হলেও গ্রামীণ জনপদে সংবাদপত্র, পত্রিকা প্রকাশের মান ও মাত্রা ছিল খুবই কম। পাকিস্তান আমলে হাতে গোনা কয়েকটি পত্রিকা প্রকাশিত হত। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পত্রিকা ম্যাগাজিন সংবাদপত্রের বেশ প্রসার ঘটে যার নেগেটিভ প্রতিক্রিয়া দেখে বঙ্গবন্ধু অনেক পত্রিকা বন্ধও করে দিতে চেয়েছিলেন। কারণ সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশে যেখানে আপামর অনাহারী, গৃহহীন, অসহায় মানুষের জীবন নিয়ে প্রত্যাশার কথা শোনাবে পত্রিকা, তা না করে সব নেগেটিভ ধ্যান ধারণা, আবেগ, ভাবাবেগ প্রকাশ করে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত নেগেটিভ ও হতাশা বিভ্রান্ত করে বিপথগামী করার চেষ্টায় লিপ্ত হয় কিছু পত্রিকা। আশির দশকের পরে পত্রিকা, ম্যাগাজিন, সংবাদপত্রের অনেক প্রসার ঘটে। আর তারই ধারাবাহিকতায় গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর উপজেলা কোন পত্রিকাই ছিল না। ১৯৯৫ এর সময়েই ঐ জনপদে সংবাদপত্রের পাঠক সৃষ্টির উদ্যোগ নেয় শাহীদ ও তার ছোটভাই এখনকার মুকসুদপুর সংবাদের সম্পাদক জনাব হায়দার হোসেন। হাঁটি হাঁটি পা পা করে ১৯৯৮ সালের দিকে জনাব হায়দার হোসেন সাংবাদিকতা জগতে প্রবেশ করে এবং কয়েকজনকে নিয়ে কাজে নেমে পড়ে। আজ জনাব হায়দার হোসেন পরিচালিত মুকসুদপুর সংবাদের পঁচিশ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। এই কাজে হাত দেয়ার মত সাহস, মনোবল, অর্থবল আর কারও মধ্যেই বিকশিত হয়নি যে কাজটি মুকসুদপুর সংবাদের প্রতিষ্ঠাকালীন সম্পাদক জনাব হায়দার হোসেন দেখিয়েছিলেন এবং গ্রামীণ সাংবাদিকতায় উন্মেষ, সম্ভাবনা, সমস্যা ও সংকট উত্তরণের এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। অথচ মুকসুদপুর উপজেলা সংবাদপত্রের বিকাশ, সাংবাদিক সৃষ্টি, কাজের প্রতি আগ্রহী করার ব্যাপারে জনাব হায়দার হোসেনের কোন বিকল্প নেই। দুর্গম চলাচলবিহীন একটি উপজেলায় এভাবে সংবাদপত্রের বিকাশে অনেক বাঁধা, সমস্যা ছিল বহুকাল থেকেই। সংবাদপত্রের বিকাশে বহু বাঁধা ও অতৃপ্তি এখনও বিদ্যমান। যেমন জনসচেতনতা, কাজের দক্ষতা, কাজের নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছতা, সততা বজায় রাখা তখনকার জনপদের জন্য খুবই কঠিন কাজ ছিল। যে জায়গাটি হায়দার হোসেন কিছুটা হলেও উন্নত করার প্রয়াস নিয়েছেন। অথচ মুকসুদপুর গ্রামীণ জনপদে সাংবাদিকতা বিচারের হাজারও বাঁধা এখন বিদ্যমান। যেমনঃ যোগাযোগ, সাংবাদিকতার প্রশিক্ষণ, দক্ষতা, যোগ্যতা ও কর্মসংস্থানের অভাব, নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির অভাব, মতাদর্শন চিন্তনের অভাব প্রকটভাবে বিদ্যমান। গ্রামীণ জনপদের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাংবাদিকতা বিষয়ক পড়াশোনা, পরিশ্রম করার অনীহা, ফটোসাংবাদিকতায় দক্ষতা না থাকা, নিরপেক্ষ বিচারে সংবাদ পরিবেশনের অদক্ষতা, উদারভাবে সংবাদ সংগ্রহে মানসিকতার অভাব, আঞ্চলিকতা, গোষ্ঠীগত ও দলীয় লেজুড়বৃত্তির সমস্যা, সাংবাদিকদের মর্যাদার অভাব, মননশীলতা, আদর্শ ও স্বচ্ছতার অভাব ইত্যাদি হাজারও সমস্যা বিদ্যমান। এসব সমস্যা নিরসনে বর্তমান যুগের শিক্ষিত উদীয়মান শ্রেণিকে এগিয়ে আসতে হবে। দরকার সাংবাদিকতা বিষয়ক শিক্ষা, প্রশিক্ষণ স্বচ্ছতার সাথে সংবাদ পরিবেশনের প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও যোগাযোগের উন্নয়ন, মানবিক প্রস্তুতি গ্রহণ। মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে কাজ করার স্বীকৃত অধিকার, মনোবল ও সাহস অর্জন করে গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশের মাধ্যমে গ্রামীণ জনপদে সাংবাদিকতা কাজের বিকাশ ঘটানোই জরুরী। এসব সমস্যা নিরসনে সামাজিক, আঞ্চলিক ও দেশীয় সকল মানবগোষ্ঠীর চেতনার বিকাশ ঘটাতে হবে। তবেই স্বাধীন সাংবাদিকতার বিকাশ ঘটবে। পরিশেষে বলা চলে, সাংবাদিকতা প্রকট চ্যালেঞ্জিং পেশা যেখানে সততা, স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা, সাহস, মনোবল, দৃঢ়চেতা যথাযথ জ্ঞান বিকাশের মাধ্যমে আমাদের যুব সমাজ, নবাগত প্রজন্মের জনগোষ্ঠীকে নিঃস্বার্থভাবে এগিয়ে আসলেই কেবলমাত্র স্বাধীন সার্বভৌম সাংবাদিকতার কর্মজজ্ঞ সুন্দরভাবে পরিচালনা করা সম্ভব। যার প্রকৃত উদাহরণ মুকসুদপুর সংবাদের সম্পাদক জনাব হায়দার হোসেন। আমার পক্ষ থেকে মুকসুদপুর সংবাদের ২৫ বছর পূর্তিতে সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও শুভকামনা রইল।